বাংলাদেশ গণমুক্তি পার্টির আহ্বায়ক এম এ আলীম সরকার বলেছেন, স্বাধীন রাষ্ট্র হওয়ার পর থেকে এই রাষ্ট্রের রাজনীতি ক্রমান্বয়ে উন্নতিশীল হয়নি। কোনো রাজনৈতিক দল রাষ্ট্রকে উন্নতির ধারায় পরিচালনা করতে পারেনি। সরকার গঠন এবং সরকারের নীতি-বিধি সৃষ্টির প্রচেষ্টা সুষ্ঠু কোনো চিন্তা ধারা ও কর্মনীতি আয়ত্ত্ব করতে পারেনি। এই ধারাক্রমের মধ্যে শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের সভাপতি হন এবং ১৯৮১ সাল থেকে আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে কাজ করে চলছেন।
তাতে ১৯৯৬ সালে নির্বাচনের মাধ্যমে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হন। তখন আওয়ামী লীগ যথেষ্ট দূর্বল ছিল। জাতীয় পার্টিকে সাথে নিয়ে প্রধানমন্ত্রী হন এবং পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকেন। এর মধ্যে বাংলাদেশের রাজনীতি উন্নতি হয়নি। পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকার পর জামায়াতে ইসলামীকে সাথে নিয়ে ২০০১ সালে বিএনপি খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে সরকার গঠন করে খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী হন। তারপর খালেদা জিয়া পাঁচ বছর ক্ষমতার পর রাজনীতি আরও সংকটে পড়ে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনে নির্বাচনের জন্য আওয়ামী লীগ ও বিএনপি এই দুই দলের নেতারাই নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে মতানৈক্য দেখা দেয় এবং ২০০৭ সালে অসাংবিধানিক অরাজনৈতিক তত্ত্ববধায়ক সরকার গঠন করে ফখরুদ্দীন আহমদের সরকার দেশ পরিচালনা করে। প্রথমে ফখরুদ্দিন আহমদের তত্ত্বাবধায়ক সরকার জনগণের জনপ্রিতা অর্জন করে এবং পরে নীতি-বিধি বহির্ভূত কাজের জন্য জনপ্রিয়তা মলিন হয়ে যায়। তাতে রাজনীতি উন্নতিশীল না হয়ে আরও সংকটে পড়ে। আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও অন্যান্য রাজনৈতিক দলের আন্দোলনের চাপে ২০০৮ সালে ২৯ ডিসেম্বর নির্বাচন অনুষ্ঠান করে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মহাজোট রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা গ্রহণের পূর্ব পর্যন্ত ডঃ ফখরুদ্দিন আহমদের তত্ত্বাবধায়ক সরকার দায়িত্ব পালন করে। শেখ হাসিনা ২০০৯ সালে মহাজোট সরকারের প্রধানমন্ত্রী হন এবং পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকার পর ২০১৪ সাল থেকে ভোটারবিহীন নির্বাচনের মাধ্যমে ২০২৪ সালের জুলাই-আগষ্ট মাসে বিপ্লবী ছাত্র-জনতার গনঅভ্যুত্থানের আগ পর্যন্ত একাধারে প্রধানমন্ত্রী ছিলেন।
বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় গতিধারা লক্ষ্য করলে এতে দেখা যায, স্বাভাবিক কোনো মানবীয় এবং কর্মসূচিগত নীতি ও কর্মসূচি অনুযায়ী হয়নি। স্বতঃস্ফূর্ত যে পরিবর্তন ২০২৪ সালে জুলাই-আগস্ট মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ ও দেশত্যাগ সংঘটিত হয়েছে, তাও ঘটেছে অপরিকল্পিত রক্তক্ষয়ী কর্মকাণ্ড অবলম্বন করে। শেখ হাসিনার শাসনকালে রাষ্ট্রক্ষমতায় তার টিকে থাকার প্রয়োজনে বিএনপির নেতা-কর্মীদের উপর জেল-জুলুম আরো নানা ধরনের অপকর্ম করা হয়েছে, তার ফলে তাকে পদত্যাগ করে বিদেশে পালাতে হয়েছে। বিদেশে অর্থপাচার, ঋণখেলাপি জাতীয় স্বার্থে প্রতিকূল অর্থনৈতিক কর্মকান্ড চালানো হয়েছে। তাতে ক্ষতিগ্রস্থ সকলের মনেই তীব্র প্রতিহিংসার মনোভাব সৃষ্টি হয়েছে। পদত্যাগের দিনই সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী, র্যাব,পুলিশ শেখ হাসিনা সরকারের প্রতি আস্থা অবিচল রেখে বিরোধীদের কর্মকাণ্ডকে হত্যাকান্ড চালিয়ে অগ্রসর হতে চায়নি। এ অবস্থায় প্রধানমন্ত্রী পদে অধিষ্ঠিত থাকা মানবীয় অস্তিত্বে বিরোধী বলে উপলব্ধি করেন, সেজন্যেই তিনি পদত্যাগের সঙ্গে দেশত্যাগও করেন। দেশি-বিদেশি পত্রিকায় শেখ হাসিনার এই দেশত্যাগের পালিয়ে যাওয়া বলে অভিহিত করেছে। এরই মধ্যে মন্ত্রিপরিষদ বাতিল হয়ে গেছে। রাষ্ট্রপতি জাতীয় সংসদ বিলুপ্ত করে দেন এবং অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনে উদ্যোগী হয়। ড. মুহাম্মদ ইউনুসকে রাষ্ট্রপতি প্রধান উপদেষ্টা করে ১৭ জনের একটি অন্তবর্তীকালীন উপদেষ্টা গঠন করে। এই ধরনের একটা ব্যবস্থা ২০০৭ সালেও করা হয়েছিল। এখনো হয়তো ঐ সময়ের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে আগামী দিনগুলোতে আরো বেশি কার্যকর ব্যবস্থা ও কর্মনীতি উদ্ভাবন করা হবে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের লক্ষ জাতীয় সংসদের সুষ্ঠু নির্বাচন সম্পন্ন করে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া আরম্ভ করা। হয়তো তাদের উদ্দেশ্য তারা সফল করতে পারবে। একটা কথা আমাদের বুঝা উচিত যে, গণতন্ত্র একটা অভিষ্ঠ বিকাশশীল। এর জন্য গভীর ও ব্যাপক চিন্তা ও অনুশীলন দরকার। আর গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল গঠন না করে কোনো রাষ্ট্রে গণতন্ত্রের নামে কোনো ব্যবস্থা প্রবর্তন করলে তা নিতান্ত সাময়িক ব্যাপার হয়। গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল অপরিহার্য। গণতন্ত্রের জন্য গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলের বিকল্প নেই। আমাদের দেশে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল গঠনে যে সামান্য প্রচেষ্টা ১৯৫০-৬০-র দশকে ছিল। ১৯৭২ সন থেকে এ পর্যন্ত আর বহাল নেই। এই সময়ে চলছে কেবল সরকার উৎখাতের ও ক্ষমতা দখলের রাজনীতি। সেই ধারাতেই হাসিনা সরকারের উৎখাত ও নতুন সরকার গঠনে প্রস্তুতি চলছে। যারা এখন রাষ্ট্রীয় জাতীয় জনজীবনকে পরিচালনার জন্য কাজ করছেন তাদের অবশ্যই গণতান্ত্রিক সরকার গঠনের জন্য রাজনৈতিক দল অপরিহার্য। এটাও বুঝতে হবে যে, পশ্চিমা বৃহৎ শক্তিবর্গ দুর্বল রাষ্ট্রগুলোতে গণতান্ত্রিক কিংবা অন্য কোনো ধরনের স্বাভাবিক রাজনীতির বিকাশ চায়না বরং তারা সে ধরনের সুষ্ঠু উদ্যোগকে ব্যর্থ করে দেওয়ার জন্যে সক্রিয় থাকে। আমাদের দরকার সুষ্ঠু অগ্রগতির জন্য গণতান্ত্রিক দল ও সরকার। সেই ধারায় অগ্রগতি ঘটাতে পারলেই গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের যাত্রা শুভকর হবে। আমরা চাই, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের প্রক্রিয়া চলছে এবং এর দ্বারা নির্বাচিত সরকার গঠনে প্রচেষ্টা সফল হোক। রাজনীতি কী এবং কি নয়? সে সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা জনগণের মধ্যে প্রচার করতে হবে। গণতন্ত্রের নানা রূপ ও প্রকৃতি আছে। বাংলাদেশের জন্য এখন আমরা কোন ধরনের গণতন্ত্র চাই তাও জনসাধারণের কাছে প্রচার করতে হবে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার নেতৃত্বে থাকতে পারেন কেবল তারাই, যারা নিজের দেশ ও জাতিকে ভিত্তিতে রেখে সর্বজনীন গণতন্ত্রের রূপ ও রীতি সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা প্রচার করে জনসাধারণকে জাগৃত করে গণতন্ত্র নিয়ে সংগ্রাম চালাতে হবে। সদিচ্ছা ও শুভকর পরিকল্পনা ও কর্মসূচি নিয়ে চেষ্টা করলেই সে চেষ্টা সফল হবে।