পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের অতিরিক্ত ডিআইজি শেখ রফিকুল ইসলাম এবং তার স্ত্রী ও আত্মীয়-স্বজনের নামে করা অবৈধ সম্পদ জব্দের জন্য অনুমতি চেয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) আবেদন করেছে অনুসন্ধান টিম।
গত ২ জুন অনুসন্ধান টিম সংশ্লিষ্ট শাখায় এই আবেদন দাখিল করে, যা বর্তমানে কমিশনের পর্যালোচনাধীন বলে জানা গেছে।
বৃহস্পতিবার (২৭ জুন) দুদকের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, অনুসন্ধান টিমের আবেদন কমিশন অনুমতি দিলেই রফিকুল ইসলামের সম্পদ জব্দের অনুরোধ আদালতে যাবে। এরপর আদালতের আদেশ অনুযায়ী পরবর্তী পদক্ষেপ নেবে দুদক।
দুদক সূত্রে জানা যায়, রফিকুল ইসলামের যেসব সম্পদ জব্দের অনুমতি চাওয়া হয়েছে সেগুলো হলো- গোপালগঞ্জ সদরে রফিকুল ইসলামের নিজ নামে থাকা ৪৯ শতাংশ জমি, মিরপুরের মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্সের ১০ শতাংশ জমি, নিকুঞ্জে পাঁচ কাঠার প্লট, গোপালগঞ্জ সদরে আরো ৬৭ শতাংশ জমি, ফার্মগেটের চারতলা ভবন, শ্বশুরের নামে রাজধানীর নাখালপাড়ায় পাঁচতলা ও ছয়তলা দুটি ভবন, ভাইদের নামে প্রায় ১০ একর জমি, গোপালগঞ্জের কানাডা সুপার মার্কেট, রফিকুল ইসলামের ভাই আমিনুলের কাকরাইলের ফ্ল্যাট, আরেক ভাই দিদারুলের নামে মোহাম্মদপুরে ফ্ল্যাট, ভাতিজি উর্মীর নামে ধানমন্ডির ফ্ল্যাট, রফিকুল ইসলামের ব্যক্তিগত দলিল লেখক উজ্জ্বল মামুন চৌধুরীর নামে কয়েক একর জমি, ভাতিজির স্বামীর নামে একটি বাড়ি, রফিকুলের স্ত্রীর নামে একটি জাহাজ, রফিকুলের শ্বশুরের নামে তিনটি জাহাজ এবং আরেক ভাই মনিরুলের ব্যবহৃত একটি জিপ। রফিকুল ইসলাম তার ও অন্যদের নামে গড়া এসব সম্পদ বিক্রি করে বিদেশে পাড়ি জমাতে পারেন বলে দুদকের অনুসন্ধান টিম আশঙ্কা করছে। এজন্য অনুসন্ধান টিম এসব সম্পদ জব্দে কমিশনের অনুমতি চেয়ে আবেদন করেছে।
শেখ রফিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে সম্পদের পাহাড় গড়ার অভিযোগ খতিয়ে দেখতে দুদকের প্রধান কার্যালয় থেকে সম্প্রতি সংস্থাটির উপপরিচালক মোহাম্মদ নূরুল হুদাকে প্রধান করে অনুসন্ধান টিম গঠন করা হয়েছে। টিমের অপর সদস্যরা হলেন সহকারী পরিচালক রণজিৎ কুমার ও মেহেদী মুসা জেবিন।
অনুসন্ধানের অংশ হিসেবে এরইমধ্যে পাবলিক সার্ভিস কমিশন, মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়, পুলিশ হেড কোয়ার্টারসহ বিভিন্ন দপ্তরে নথিপত্র তলব করে চিঠি দেওয়া হয়েছে। গত ১৩ মে পুলিশ মহাপরিদর্শক বরাবর চিঠি দেওয়া হয়।
এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে মোবাইল ফোনে কল করে এবং এসএমএস পাঠিয়ে অতিরিক্ত ডিআইজি রফিকুল ইসলাম শিমুলের সাড়া পাওয়া যায়নি।
দুদকের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, পুলিশ কর্মকর্তা রফিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে অভিযোগ, বাবার মৃত্যুর পর মুক্তিযোদ্ধার ভুয়া সার্টিফিকেট তৈরি করে সরকারি চাকরিতে যোগদান করেছেন। এমনকি সরকারি জমিও গ্রহণ করেছেন। এছাড়া চাকরির প্রভাব বিস্তার করে ঘুষ-দুর্নীতির মাধ্যমে শত শত কোটি টাকার সম্পদ অর্জন করেছেন। এসব অভিযোগ খতিয়ে দেখতে কমিশনের অনুমোদনক্রমে অনুসন্ধান টিম গঠন করা হয়েছে। অনুসন্ধান টিম সরকারি বিভিন্ন দপ্তরে চিঠি দিয়ে সংশ্লিষ্ট নথিপত্র সংগ্রহ করছে। বিস্তারিত প্রতিবেদন পাওয়া গেলে প্রকৃত সত্য বেরিয়ে আসবে।
রফিকুল ইসলামের অবৈধ সম্পদের মধ্যে রয়েছে ১০ থেকে ১৫ কোটি টাকা মূল্যের ৪টি জাহাজ, গুলশানের ইউনাইটেড হাসপাতালের পাশে ৬ হাজার বর্গফুটের অ্যাপার্টমেন্ট, গোপালগঞ্জ সদরে অবস্থিত ৫ কোটি টাকা মূল্যের গ্রামের বাড়ি, ঢাকা ও গোপালগঞ্জের বিভিন্ন স্থানে ভবন ও নিজ নামে জমি। এছাড়া সম্পদ গড়েছেন স্ত্রী ও ভাইদের নামেও। এছাড়া তিনি মানিল্ডারিংয়ের মাধ্যমে বিভিন্ন দেশে প্রচুর অর্থ পাচার করেছেন এবং দুবাইয়ে তার একটি স্বর্ণের দোকান রয়েছে।
রফিকুল ইসলামের নামে যত অভিযোগ
# অতিরিক্ত ডিআইজি রফিকুল ইসলাম তার মৃত বাবা রাজ্জাক শেখের নামে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদ তৈরি করে ২০০১ সালে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় ২০তম বিসিএস-এ এএসপি পদে যোগদান করেন।
# পুলিশ বাহিনীতে যোগদানের সময় গোপালগঞ্জের পাইককান্দি ইউনিয়নে তার ছোট একটি টিনের ঘর ছিল। যার অস্তিত্ব এখনো বিদ্যমান। নিজ এলাকায় ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে ২৭ নং বিজয়পাশা মৌজায় খাস খতিয়ানে ১.০৭ একর জমি ভাই ও ভাগ্নি জামাই সেলিম মীরের নামে তিন বছরের জন্য লিজ নেন। যেখানে অবৈধভাবে বালু দিয়ে ভরাট করে স্থায়ীভাবে দখল করে নিয়েছেন। খাস জমির সঙ্গে আসমা বেগম নামে এক নারীর প্রায় ৩ কাঠা জমিও দখল করেছেন। সবমিলিয়ে তার পরিবার ১.৫৬ একর জমি দখল করেছে, যেখানে তিনি বিলাসবহুল ডুপ্লেক্স বাড়ি নির্মাণ করছেন। যার বর্তমান বাজার মূল্য তিন কোটি টাকা বলে জানা গেছে।
# ১০ বছরের বেশি সময় ধরে ৮২/২, ইন্দিরা রোড, ফার্মগেটের বাড়িতে বসবাস করছেন। বহুতল ফাউন্ডেশন করে চারতলা ভবন এবং বিলাসবহুল আসবাবপত্র গড়েছেন, যার বাজার মূল্য প্রায় ৫৬ কোটি টাকা। ওই বাড়ির সব ফ্ল্যাটে বাসা ভাড়া দেওয়া হচ্ছে।
# স্ত্রী ফারজানা রহমানের নামে গোপালগঞ্জের পাইককান্দি ইউনিয়নে আমুড়িয়া মৌজায় ৪৯ শতাংশ জমি ২০১৫-১৬ সালে ক্রয় করেন রফিকুল। জমির বর্তমান বাজার মূল্য ৯৮ লাখ টাকা। এছাড়া স্ত্রীর নামে ২০২২ সালে গুলশানে ঢাকা ইউনাইটেড হাসপাতালের পাশে ১৪ কোটি ৫৫ লাখ টাকা দিয়ে ৬ হাজার বর্গফুটের ফ্লোর এবং রাজউকের ঝিলমিল প্রকল্পে ১০ কোটি টাকা ব্যয়ে ২টি প্লট ক্রয় করেছেন।
# গোপালগঞ্জ সদর উপজেলার ২৭ নং বিজয়পাশা মৌজায় তার পাঁচ নম্বর ভাই মাহফুজুর রহমানের নামে জমি ক্রয় করে সেখানে বহুতল ফাউন্ডেশন দিয়ে মার্কেট নির্মাণ করেছেন। মার্কেটের নাম ‘কানাডা সুপার মার্কেট’। ওই ভাইয়ের নামে গোপালগঞ্জ সদরে ২০২০ সালের জানুয়ারি মাসে দেড় কোটি টাকা মূল্যের জমিও কিনেছেন।
# মিরপুর চিড়িয়াখানার পাশে এক ব্যক্তির নামে আনুমানিক ২ বিঘা জমি ১২ কোটি ১৯ লাখ টাকায় ক্রয় করেছেন। সেখানে টিনশেড ভবন করে ৬৩টি রুম ভাড়া দেওয়া আছে।
# মেজো বোনের স্বামী শাফায়েত হোসেন মোল্লার নামে গোপালগঞ্জ বঙ্গবন্ধু সড়কের পাশে দেড় কোটি টাকা মূল্যের জমি ক্রয় করেছেন। একই এলাকার পাইককান্দি এলাকায় ভাগ্নে জামাই সেলিম মীরের নামে ৪৮ লাখ টাকা ব্যয় করে তিনতলা ফাউন্ডেশনের ভবন ও দোকান করে দিয়েছেন।
# পাঁচ ভাইয়ের নামে গোপালগঞ্জ রেল স্টেশনের আশপাশে বিভিন্ন সময়ে ৪২ কোটি টাকা ব্যয়ে জমি কিনেছেন। এছাড়া তাদের নামে পূর্বাচল প্রকল্পে ৫টি প্লট বুকিং রয়েছে, যার কিস্তির টাকা তিনি দিচ্ছেন।
# রফিকুলের অবৈধ অর্থের বাহক দলিল লেখক উজ্জ্বল মামুন চৌধুরী। মামুন ও তার পাঁচ নম্বর ভাই মাহফুজুর রহমানের নামে গোপালগঞ্জ সদরের সুকতাইল গ্রামে ১৬ কোটি টাকা ব্যয়ে ৪০ বিঘা জমিতে মৎস্য খামার করেছেন রফিকুল। ভাই মাহফুজুর রহমানের নামে গোপালগঞ্জ সদরের ৬ নং পাইককান্দি ইউনিয়নে আরও ২০ কাঠা জমি ক্রয় করা হয়েছে।
# উজ্জ্বল মামুন চৌধুরী সবার কাছে পুলিশ কর্মকর্তা রফিকুল ইসলামের ভাগ্নে হিসেবে পরিচিত। তিনি গোপালগঞ্জ সদর হাসপাতালের পাশে এক কোটি ৭০ লাখ টাকা মূল্যের তিনতলা ভবন নির্মাণ করেছেন।
# রফিকুলের তিন নম্বর বোন ফেরদৌস আরার নামে একটি ব্যাংকে ১০ কোটি টাকার এফডিআর রয়েছে। তিন নম্বর ভাই আমিনুল ইসলামের (বেকার) নামে রাজধানীর কাকরাইলে কর্ণফুলী গার্ডেনে ১৮ ডি ফ্ল্যাটে এক কোটি ১০ লাখ টাকার ফ্ল্যাট ক্রয় করেছেন।
# দ্বিতীয় নম্বর ভাই এস. এম দিদারুল ইসলাম বা তার স্ত্রী সাঈদা আমেলী জামানের নামে রাজধানীর মোহাম্মদপুরের কাদেরবাদ হাউজিংয়ে ৮০ লাখ টাকার একটি ফ্ল্যাট ক্রয় করেছেন রফিকুল।
# বড় ভাই এস. এম নুরুল ইসলাম সরকারি দপ্তরের ক্লার্ক। তার নামে ঢাকায় তিনটি ফ্ল্যাট ক্রয় করা হয়েছে। যার বাজার মূল্য প্রায় আড়াই কোটি টাকা। ভাইয়ের মেয়েকে বেসরকারি মেডিকেল কলেজে পড়ার যাবতীয় খরচ রফিকুল বহন করছেন।
# জাহাঙ্গীর আলম নামে এক রাজমিস্ত্রী রফিকুল ইসলামের ব্যবসা দেখভাল করেন। ওই জাহাঙ্গীর আলম এখন একটি ডেভেলপার কোম্পানির মালিক। বর্তমানে কুড়িল বিশ্বরোডের পাশে সাততলা ভবন নির্মাণের কাজ করছেন, যার প্রকৃত মালিক রফিকুল।
# স্ত্রী ফারজানা খানম ও তার ভাই মাহফুজুর রহমানের নামে গোপালগঞ্জ সদরে এক কোটি ৩০ লাখ টাকা মূল্যের সম্পত্তি ক্রয় করেছেন রফিকুল। মাহফুজুর রহমান কানাডা-বাংলাদেশ হুন্ডির ব্যবসায় সম্পৃক্ত। যা রফিকুল ইসলামের টাকায় করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
# চাকরি ক্ষেত্রে নিয়োগ ও বদলি বাণিজ্য করে প্রায় পাঁচ কোটি টাকার অবৈধ আয় করেছেন। তার স্ত্রীর ভাই আব্দুল্লাহ আল মামুন ঢাকায় শিপিং ব্যবসা করছেন। এছাড়া গোপালগঞ্জ সদরে তিনি পাঁচ কোটি টাকা বিনিয়োগ করে চক্ষু হাসপাতাল নির্মাণ করেছেন। কাগজে কলমে যার মালিক শাহারিয়ার মুন্সি নামে এক ব্যক্তি। কিন্তু দেখাশোনা করেন তার স্ত্রী। তার তিন ভাইয়ের নামে যৌথ কারবারের ব্যবসায় ২০ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেছেন। স্ত্রী ফারজানা ও ভাগ্নি তানজিলা হক উর্মির নামে সাড়ে তিন কোটি টাকার স্বর্ণও রয়েছে। যা ব্যাংকের লকারে রাখা আছে বলে অভিযোগে উল্লেখ করা হয়েছে।