সেনাসমর্থিত এক-এগারোর সরকারের সময় ২০০৭ সালের ৭ মে যুক্তরাষ্ট্র থেকে লন্ডন হয়ে সরকারের বাধা উপেক্ষা করে দেশে ফেরার প্রসঙ্গে জাতীয় সংসদে বক্তব্য রাখেন প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা শেখ হাসিনা। ওই সময়কার ঘটনা বর্ণনা করে তিনি বলেন, বারবার গ্রেফতার হয়েছি। অনেক বাধা, সরাসরি গুলি, বোমা, গ্রেনেড সব কিছু অতিক্রম করে আজ জনগণের সেবা করতে পারছি। সাহসের সঙ্গে এগিয়ে চলে জনগণের জন্য কাজ করে যাচ্ছি। জনগণের শক্তি নিয়েই এগিয়ে যাচ্ছি। সেদিন সরকারের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে বিমানবন্দরে স্বাগত জানানোর জন্য দলের নেতাকর্মী ও দেশবাসীর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান আওয়ামী লীগ সভাপতি।
Advertisement
মঙ্গলবার জাতীয় সংসদে আলোচনায় অংশ নিয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য এবং সরকারের মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী আব্দুর রহমান ২০০৭ সালের ৭ মে শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন নিয়ে সংসদে অনির্ধারিত আলোচনার সূত্রপাত করেন। বিষয়টি নিয়ে সরকারি দলের অপর এমপি ও আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেনও কথা বলেন। পরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আজকের দিনটি আমার জন্য অনন্য দিন। আমি সেদিন শতবাধা অতিক্রম করে ফিরে এসেছিলাম। সেই সময় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অনেক উপদেষ্টাও ফোন করে বলেছিলেন আপনি আসবেন না। আপনার বাইরে থাকার যা যা লাগে আমরা করব। আবার কেউ কেউ আমাকে ধমকও দিয়েছিলেন। এ কথাও বলা হয়েছিল- বাংলাদেশে ফিরলে বিমানবন্দরেই মেরে ফেলা হবে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন- আমি বলেছিলাম আলহামদুলিল্লাহ, বাংলাদেশের মাটিতেই মরব; কিন্তু আমি আসব। সমস্ত এয়ারলাইন্সকে নিষেধ করা হয়েছিল আমাকে যাতে বোর্ডিং পাশ দেওয়া না হয়। আমেরিকার বিমানবন্দরে তিন ঘণ্টা দাঁড়িয়ে তাদের সঙ্গে ঝগড়া করে ব্রিটিশ এয়ারওয়েজে করে লন্ডনে আসি। সেখানে আসার পরে যখন প্লেনে উঠতে যাব, তখন আমাকে উঠতে দেওয়া হয়নি। সেদিন প্রতিজ্ঞা করেছিলাম যেভাবেই হোক বাংলাদেশে আসব। এমনকি যখন আমি বিমানবন্দরে রওনা হই তখন অনেকেই ফোন করে বলেছিলেন- আপনি আসবেন না, আসলে মেরে ফেলে দেবে। আমি পরোয়া করিনি।
এক-এগারোর সরকারের সময় গ্রেফতার হওয়ার আগে রাজধানীর একটি হাসপাতালে ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসাধীন বিশিষ্ট সঙ্গীতশিল্পী সাবিনা ইয়াসমিনকে দেখতে যাওয়ার প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, আমি অনেকটা গেরিলা কায়দায়ই বেরিয়ে গিয়েছিলাম। কারণ আমি জানি আমাকে বেরুতে দেবে না। সেই সময়ে পুলিশের চোখ এড়িয়ে সোজা হাসপাতালে চলে যাই। তখন আমি কতগুলো কথা বলেছিলাম। কারণ সেই সময় দেশ চালাচ্ছে কে সেটা আমার প্রশ্ন ছিল। সেদিন আমি খুব কড়া কথা কিছু বলি। পরদিন সকালেই পুলিশ হাজির, আর্মি হাজির এবং আমাকে অ্যারেস্ট করে। সংসদ ভবনের একটা… তখন ওটা প্রায় পরিত্যক্ত অবস্থায় ছিল, সেখানে আমাকে নিয়ে আসে। সমস্ত একেবারে ফাংগাস পরা। খুবই নোংরা একটা ভবন। সেখানে আমাকে বন্দি করে রাখে।
আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, তখন বলা হয়েছিল কেউ যাতে বিমানবন্দরে না যায়। এমনকি আমার দলের ভেতর থেকেও…তখন দলের যিনি সাধারণ সম্পাদক ছিলেন- তিনি সবাইকে বলে দিয়েছিলেন কেউ বিমানবন্দরে গেলে বহিষ্কার করা হবে। কয়েকজনের নাম নির্দিষ্ট করা ছিল, আমাদের নেতাকর্মী কেউ রাস্তায় থাকতে পারবে না। আমি শুধু মেসেজ দিয়েছিলাম সবাই থাকবে। তবে আমরা গেরিলা যুদ্ধ করেছি, সবাই ঘাসের সঙ্গে মিশে থাকবা। আমি প্লেন থেকে না নামা পর্যন্ত তোমরা বের হবে না।
ওই সময় ছোট বোন রেহানার ভূমিকা তুলে ধরে তিনি বলেন, আমি যখন বন্দি ছিলাম, আমার ছোট বোন রেহানা সে রাজনীতি করে না। সামনে নেই; কিন্তু সে অসাধ্য সাধন করতে পারে। প্রত্যেকটা জেলা-উপজেলার সব নেতাকর্মী সবার সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছে। ওই লন্ডনে বসেই সে কাজ করেছে। তার জন্যও আমার দোয়া রইল।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাকে বলা হয়েছিল গাড়িতে উঠলে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যাওয়া হবে। আমি উঠে ড্রাইভারকে বলেছিলাম যেখানে মানুষ আছে সেখান দিয়ে যাবা। ফ্লাইওভারে উঠবা না। হাজার হাজার মানুষ রাস্তায়। আমি কৃতজ্ঞতা জানাই পার্টির নেতাকর্মীদের, সেদিন তারা একদিকে রক্তচক্ষু উপেক্ষা করেছে, আরেকদিকে আমাদের দলের কিছু লোকের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থেকে সংবর্ধনা দিয়েছিল। এটা সংবর্ধনাই শুধু নয়, আমাকে নিরাপত্তাও দিয়েছে। যেন আমাকে কোনো দিকে নিতে না পারে। এরপর তো একপ্রকার হাউস অ্যারেস্ট (সুধা সদন) ছিলাম। কাউকে ঢুকতে দিত না। হঠাৎ কালেভদ্রে দু’একজন আসতে পারত আমার কাছে।
তিনি বলেন, শুধু ওই দিন নয়, ১৯৮৩ সালে এরশাদ সাহেবও আমাদের গ্রেফতার করে নিয়ে গিয়েছিল ৩০ নম্বর হেয়ার রোড, লাল দালান, সেখানে রেখেছিল। সেখান থেকে ডিজিএফআইয়ের অফিসে নিয়ে যায় জিজ্ঞাসাবাদ করতে। এরশাদ সাহেবের সময় বেশ কয়েকবার গ্রেফতার করে, হাউস অ্যারেস্ট করে। কখনো সারা রাত কন্ট্রোল রুমে বসিয়ে রাখে। এরকম বারবার গ্রেফতারও হয়েছি। অনেক বাধা, সরাসরি গুলি, বোমা, গ্রেনেড সব কিছু অতিক্রম করে আজ এখানে এসে জনগণের সেবা করতে পারছি। আমি বাংলাদেশের জনগণ ও আমার দলের নেতাকর্মীদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাতে দাঁড়িয়েছি। আজ অনেকে বেঁচে নেই। তারা এবং সাধারণ জনগণ রক্ত চক্ষু উপেক্ষা করে সেদিন গিয়েছিলেন। যার জন্য আমি দেশে ফিরে আসতে পেরেছি।
সংসদ নেতা বলেন, আমি প্রতিজ্ঞা করেছিলাম আমি ফিরে আসবই। ১৭ মে (১৯৮১ সাল) ওইভাবে এসেছিলাম। পরে ২০০৭ সালের ৭ মে এসেছিলাম। আমি সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই। জাতির পিতার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এটুকু বলতে চাই- বাবা-মা আমাদের শিখিয়েছেন সাহসের সঙ্গে এগিয়ে চলা। সেই সাহসের সঙ্গে এগিয়ে চলে জনগণের জন্য কাজ করা। সেটাই আমি করে যাচ্ছি। বাবা, মা, ভাইদের হারিয়ে আমার আর কিছুই ছিল না। দেশের জনগণই আমার একমাত্র শক্তি ও প্রেরণা। এ শক্তি নিয়েই এগিয়ে যাচ্ছি। বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে। বাংলাদেশকে জাতির পিতার স্বপ্নের বাংলাদেশ করব।