আগামী জুলাইয়ের শেষার্ধে দ্বিপক্ষীয় সফরে ব্রাজিল যাবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সফরে দেশটির সঙ্গে রাজনৈতিক সম্পর্ক দৃঢ় করার পাশাপাশি বাণিজ্য সম্পর্ক গুরুত্ব পাবে। এ ছাড়া সফরে ব্রাজিলের সঙ্গে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা, কৃষিসহ কয়েকটি সমঝোতা স্মারক সই হতে পারে।
কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, আগামী ২০ জুলাইয়ের পর সরকারপ্রধানের ব্রাজিল সফরের প্রস্তুতি চলছে। এ সফরে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা, কৃষিসহ ৭ থেকে ৮টি সমঝোতা স্মারক সই করার বিষয়ে উভয়পক্ষ কাজ করছে।
বাংলাদেশের কোনো শীর্ষ রাজনৈতিক নেতা প্রথম দ্বিপক্ষীয় সফরে ব্রাজিল যাবেন। সফরটি বেশ তাৎপর্যপূর্ণ হবে বলে মনে করছেন কূটনৈতিক অঙ্গন সংশ্লিষ্টরা। কেননা, এই সফরে লাতিন আমেরিকার গুরত্বপূর্ণ দেশটির সঙ্গে যেমন রাজনৈতিক সম্পর্ক দৃঢ় করার সুযোগ রয়েছে, তেমনি বাণিজ্য ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সহযোগিতা পথ বিস্তৃত হতে পারে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক জ্যৈষ্ঠ কর্মকর্তা জানান, প্রেসিডেন্ট লুলা ডি সিলভার আমন্ত্রণে ব্রাজিল সফরে যাবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। চীন সফরের পর ব্রাজিল সফরে যাবেন প্রধানমন্ত্রী। তবে এখনো তারিখ চূড়ান্ত হয়নি। জুলাইয়ের তৃতীয় সপ্তাহের শেষাংশে হওয়ার সম্ভবনা রয়েছে, তবে ২০ জুলাইয়ের পর হবে।
সরকারপ্রধানের সফরে কয়টি চুক্তি বা সমঝোতা স্মারক সই হতে পারে— এমন প্রশ্নে এ কূটনীতিক বলেন, কোনো চুক্তি হবে না। কিছু সমঝোতা স্মারক সই হতে পারে। কৃষি, প্রতিরক্ষা সহযোগিতাসহ আরও কিছু সমঝোতা সই হবে।
গত এপ্রিলে ঢাকা সফর করেছিলেন ব্রাজিলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাউরো ভিয়েরা। এটি দেশটির প্রথম কোনো পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ঢাকা সফর ছিল। ওই সফরে প্রেসিডেন্টের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে ব্রাজিল সফরের আমন্ত্রণ জানান ভিয়েরা। তিনি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে ব্রাজিলের প্রেসিডেন্টের আমন্ত্রণপত্র পৌঁছে দেন।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, প্রধানমন্ত্রীর ব্রাজিল সফরে রাজনৈতিক গুরুত্ব আছে। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ব্রাজিলের প্রেসিডেন্টের আলাদা সৌহার্দপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে। নারীর ক্ষমতায়নে ভূমিকা রাখায় ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে পছন্দ করেন। ব্রাজিল বড় অর্থনীতির দেশ, ব্রিকসের সদস্য। দেশটির সঙ্গে ভালো সম্পর্ক থাকলে বাংলাদেশের অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হওয়ার সুযোগ রয়েছে। সবমিলিয়ে এটা একটা ভালো সফর হবে বলে আশা করা যায়।
এদিকে, মঙ্গলবার (২৫ জুন) পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে প্রধানমন্ত্রীর ব্রাজিল সফর নিয়ে পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেনের সভাপতিত্বে এক আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠক হয়। বৈঠকে প্রধানমন্ত্রীর সফর নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। বৈঠকে অংশ নেওয়া এক সরকারি কর্মকর্তা জানান, ব্রাজিলের সঙ্গে বাণিজ্য খাতটা আরও বিস্তৃত করার বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। ব্রাজিল থেকে আমরা কোন কোন খাতে সহযোগিতা পেতে পারি, সেগুলো নিয়ে আলোচনা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর সফরে ৭ থেকে ৮টির মতো দলিল সই করার বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। এর মধ্যে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা ও কৃষি রয়েছে।
কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছেন, প্রধানমন্ত্রীর সফরে ব্রাজিলে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে শুল্কমুক্ত সুবিধা পাওয়া, ওষুধ রপ্তানি, ইথানল আমদানি বা দেশে ইথানল উৎপাদনে সহায়তা, সুনীল অর্থনীতির ক্ষেত্রে গভীর সমুদ্রে মাছ ধরা ও সামুদ্রিক পর্যটনে সহায়তা আলোচ্য সূচিতে থাকতে পারে।
অন্যদিকে ব্রাসিলিয়া বাংলাদেশে গরুর মাংস রপ্তানি, ইথানল রপ্তানি, তুলার রপ্তানি বাড়ানো, পোলট্রি ও ফিশ ফিড বিক্রি করার বিষয়ে জোর দিতে পারে। এ ছাড়া, ব্রিকসে নতুন সদস্য পদ না হোক, অন্তত যে কোনো ফরমেটে বাংলাদেশকে যুক্ত করার বিষয়ে হয়ত প্রধানমন্ত্রী ব্রাজিলের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে আলাপ করতে পারেন।
গত এপ্রিলে ব্রাজিলের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ঢাকা সফরে দেশটির সঙ্গে কারিগরি সহযোগিতা সংক্রান্ত একটি চুক্তি সই করেছে বাংলাদেশ। এ চুক্তি ব্রাজিলের সঙ্গে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ার পথ সুগম করেছে। ব্রাজিলের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য-বিনিয়োগ বাড়াতে অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য চুক্তি (পিটিএ) অথবা মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) সই করতে চায় বাংলাদেশ। পাশাপাশি মার্কোসুরভুক্ত (লাতিন আমেরিকার কয়েকটি দেশের জোট) দেশগুলোর সঙ্গে পিটিএ চুক্তির ক্ষেত্রে ব্রাজিলের সহযোগিতা চায় বাংলাদেশ। হয়ত প্রধানমন্ত্রী ব্রাজিল সফরে গুরত্বসহকারে এসব বিষয় তুলবেন।
এ প্রসঙ্গে অর্থনীতিবিদ মাহফুজ কবির বলেন, দেশের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক কূটনীতির যে প্যাকেজ হাতে নিয়েছে, তার জন্য বড় একটা জায়গা হতে পারে লাতিন আমেরিকা। সেখানকার অর্থনীতি বেশ বড়। বিশেষ করে ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, পেরু ও চিলি। ব্রাজিলের সঙ্গে আমাদের ট্যারিফ প্রায় দ্বিগুণ। ট্যারিফ মওকুফ করার জন্য এফটিএ করা ছাড়া কোনো উপায় নেই। যত দ্রুত সম্ভব এফটিএ’র নেগোসিয়েশন করতে হবে। কারণ, এ সমস্ত দেশগুলো আমাদের জন্য নিরাপদ। এরা কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে আমাদের প্রতিযোগী নয়।
এ অর্থনীতিবিদ মনে করেন, এফটিএ করতে পারলে আমাদের লাভ হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। তারা হয়ত আমাদের দেশে এতটা রপ্তানি করবে না, কিন্তু তাদের দেশে আমাদের রপ্তানি বেশি হওয়ার সম্ভাবনা আছে। এ কাজগুলো দ্রুত করতে হবে। সামনে আমাদের এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন আছে। সেজন্য আমাদের এখন থেকে বিকল্প বাজার নিশ্চিত করতে হবে।
সংশ্লিষ্টদের দেওয়া তথ্য বলছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে দুইপক্ষের মধ্যে দুই দশমিক ৫২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বাণিজ্য হয়েছে। বাংলাদেশ হচ্ছে ব্রাজিলের তুলা এবং চিনির দ্বিতীয় বৃহত্তম, সয়াবিন ও সয়াবিন তেলের তৃতীয় বৃহত্তম আমদানিকারক দেশ।
অন্যদিকে বাংলাদেশ থেকে তৈরি পোশাক আমদানি করে ব্রাজিল। ব্রাজিল থেকে প্রায় ৫০ কোটি ডলারের তুলা আমদানি করলেও ওই বাজারে বাংলাদেশ কোনো শুল্কমুক্ত সুবিধা পায় না। বাংলাদেশকে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে প্রায় ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ শুল্ক দিতে হয়।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই শুল্ক দিতে চায় না বাংলাদেশ অথবা বাংলাদেশের চাওয়া বাংলাদেশে যে পরিমাণ তুলা আমদানি করা হয় সেটি দিয়ে যে কাপড় তৈরি হবে তা যেন শুল্কমুক্ত সুবিধা পায়। কিংবা তুলা আমদানির সমপরিমাণ পণ্যের ওপর শুল্কমুক্ত সুবিধা চায় বাংলাদেশ। ব্রাজিল থেকে ইথানল আমদানি বা উৎপাদনে প্রযুক্তিগত সহায়তা পেতে পারে বাংলাদেশ। এ ছাড়া, সুনীল অর্থনীতির ক্ষেত্রে সহযোগিতা পাওয়ার সুযোগ রয়েছে বাংলাদেশের।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক মো. রুহুল আমিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, লাতিন আমেরিকার সঙ্গে আমরা সেই অর্থে সম্পর্ক তৈরি করিনি। লাতিন আমেরিকার সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক আরও বিস্তৃত করা দরকার। ব্রাজিল উদীয়মান অর্থনীতির দেশ। তারা ব্রিকসের গুরত্বপূর্ণ সদস্য। রাজনৈতিক, অর্থনীতিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর সফরের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের জন্য অবারিত সুযোগ তৈরি হবে। ব্রাজিলের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কটা ভালো, ভবিষ্যতে আমাদের অর্থনীতি উপকৃত হবে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ব্রাজিল গুরত্বপূর্ণ। ব্রাজিলের সমর্থন দরকার আছে আমাদের।
প্রসঙ্গত, দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানেসবার্গে ১৫তম ব্রিকস শীর্ষ সম্মেলনের ফাঁকে ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুলা ডি সিলভার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ হয়েছিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার।
এদিকে, আগামী ৮-১১ জুলাই বেইজিং সফর করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বেইজিং সফরের পর প্রধানমন্ত্রী ব্রাজিল সফরে যাবেন।