রাজধানীর ডেমরায় গত বছরের ২৮ অক্টোবর দিবাগত গভীর রাতে অছিম পরিবহণের বাসে আগুন দিয়ে জীবন্ত মানুষকে পুড়িয়ে মারা হয়। বিএনপির শীর্ষ নেতাদের নির্দেশে ওই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটানো হয়েছিল বলে দাবি করেছে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিট।
এ ঘটনায় অভিযুক্ত বিএনপির তিন নেতাকর্মীকে গ্রেফতারও করেছে সিটিটিসির স্পেশাল অ্যাকশন গ্রুপ বিভাগের অ্যান্টি ইলিগ্যাল আর্মস অ্যান্ড ক্যানাইন টিম।
গ্রেফতাররা হলেন- ঢাকা মহানগর দক্ষিণ ছাত্রদলের সাবেক সহ-সভাপতি মো. নুরুল ইসলাম মনির ওরফে মনির মুন্সি, নারায়ণগঞ্জ মহানগর যুবদলের সদস্য সচিব ও নারায়ণগঞ্জ মহানগর ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি মো. সাহেদ আহমেদ এবং বিএনপি কর্মী ও মনির মুন্সির ব্যক্তিগত ড্রাইভার মাহাবুবুর রহমান সোহাগ। তাদের কাছ থেকে ঘটনার সময় ব্যবহৃত প্রাইভেটকারটি জব্দ করা হয়েছে।
শনিবার দুপুরে রাজধানীর মিন্টুরোডে ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এ বিষয়ে বিস্তারিত জানান অতিরিক্ত কমিশনার ও সিটিটিসি প্রধান মো. আসাদুজ্জামান।
সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে আসাদুজ্জামান বলেন, মনির মুন্সি নির্দেশদাতাদের থেকে নির্দেশনা পেয়ে এই কাজ শুরু করেন। তিনি আরও বড় ধরনের ঘটনা ঘটাতে চেয়েছিলেন। দলের আরও বড় পদ পাওয়ার প্রত্যাশায় ছিলেন তিনি।
ঘটনার নির্দেশদাতাদের শনাক্ত করা হয়েছে কি না- জানতে চাইলে তিনি বলেন, অগ্নিসংযোগের ঘটনায় নির্দেশদাতাদের নাম আমরা পেয়েছি। তাদের বিষয়ে তদন্ত চলছে। তাদেরও গ্রেফতার করা হবে। তবে তদন্তের স্বার্থে তাদের বিষয়ে এখনই কোনো তথ্য বলব না।
সিটিটিসি প্রধান বলেন, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন বানচালের উদ্দেশে ২০২৩ সালের ২৮ অক্টোবর বিএনপি রাজধানীর পল্টন এলাকায় নারকীয় তাণ্ডব চালায়। বিএনপির নেতাকর্মীরা সেদিন প্রধান বিচারপতির বাসভবনে হামলা ও পুলিশ সদস্যকে পিটিয়ে হত্যা করার মতো জঘন্য কাজসহ অসংখ্য গাড়ি ভাঙচুর এবং অগ্নিসংযোগ করে। তারই ধারাবাহিকতায় ২৮ অক্টোবর দিবাগত রাতে ডেমরার দেইল্লা বাসস্ট্যান্ডে রাখা অছিম পরিবহণের একটি গাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে। তাদের দেওয়া আগুনে ওই বাসে ঘুমিয়ে থাকা হেলপার মো. নাইম ঘটনাস্থলে পুড়ে মারা যান এবং অপর হেলপার মো. রবিউল দগ্ধ হয়ে মারাত্মক আহত হন। এ ঘটনায় ডেমরা থানায় একটি মামলা হয়। গত বছরের ১১ নভেম্বর মামলাটি সিটিটিসিতে হস্তান্তর করা হয়। মামলাটি তদন্ত শুরু করে সিটিটিসির স্পেশাল অ্যাকশন গ্রুপ বিভাগের অ্যান্টি ইলিগ্যাল আর্মস অ্যান্ড ক্যানাইন টিম।
অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার বলেন, তদন্তভার গ্রহণের পর ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে ঘটনাস্থলের চারপাশের সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করে একটি হ্যারিয়ার গাড়ি শনাক্ত করা হয়, যা ওইদিন অগ্নিসংযোগে ব্যবহৃত হয়েছিল। এই গাড়ির সূত্র ধরে ঢাকা মহানগরীর বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে মূল অগ্নিসংযোগকারী ও তার সহযোগীদের গ্রেফতার এবং ঘটনায় ব্যবহৃত গাড়িটি জব্দ করা হয়।
ঘটনার বিবরণ তুলে ধরে এই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, মনির মুন্সি তার নেতাদের কাছ থেকে নির্দেশনা পান। নির্দেশনার মূল বিষয়বস্তু ছিল নাশকতার মাত্রা আরও বাড়ানো এবং এমন কোনো ঘটনা ঘটানো যাতে করে জনমনে ব্যাপক আতঙ্কের সৃষ্টি হয়। তারই অংশ হিসেবে তিনি (মনির) বেশ কয়েকজনকে অগ্নিসংযোগের জন্য নিয়োগ দেন এবং তিনি নিজে বড় একটি ঘটনা ঘটানোর জন্য তার অপর সহযোগী নারায়ণগঞ্জ যুবদলের সদস্য সচিব ও তার বন্ধু সাহেদ আহমেদকে ডেকে নেন। তারা দুজনে মিলে একটি পরিকল্পনা করে এমন একটি ঘটনা ঘটাবেন যাতে জনমনে ব্যাপক আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। এই পরিকল্পনারই অংশ হিসেবে ডেমরা এলাকার দেইল্লা বাসস্ট্যান্ড এলাকায় রাত দুইটার পর বেশ কয়েকবার গাড়ি দিয়ে ঘুরে ঘুরে রেকি করেন এবং দেখতে থাকেন কোন জায়গাটা সিসিটিভি ক্যামেরার আওতামুক্ত।
তিনি বলেন, অবশেষে তারা (মনির ও তার সহযোগীরা) কাঙ্ক্ষিত টার্গেট নির্ধারণ করে বড়ভাঙ্গা মার্কেটে চলে যান। সেখান থেকে তারা দুই লিটারের পানির বোতলে পেট্রল সংগ্রহ করে আনুমানিক ভোর তিনটায় ঘটনাস্থলে পৌঁছান। ঘটনাস্থলের নিরাপদ দূরত্বে গাড়ি থামিয়ে চালক মাহাবুবুর রহমান সোহাগ গাড়িতে অবস্থান করেন এবং মনির মুন্সি ও সাহেদ পেট্রলের বোতল নিয়ে রাস্তার পাশে পার্কিং করা অছিম পরিবহণের গাড়ির কাছে যান। সেখানে গাড়ির চালকের সিটের পাশে থাকা খোলা গ্লাসের অংশ দিয়ে চালকের সিটে মনির মুন্সি পেট্রল ঢেলে দেন। এরপর দিয়াশলাই দিয়ে আগুন ধরিয়ে দেন। নিমিষেই গাড়িতে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। আগুন লাগিয়ে তারা গাড়িতে করে দ্রুত স্থান ত্যাগ করেন। তারা এক্ষেত্রে সম্ভাব্য বিপদ এড়ানোর জন্য উল্টো পথে ডেমরা এক্সপ্রেসওয়েতে ওঠে সুফিয়া কামাল ব্রিজ দিয়ে ভুলতায় থাকা মনির মুন্সিদের মালিকানাধীন ‘মুন্সি পেট্রল পাম্প’-এ রাত্রিযাপন করেন। সকাল দশটার দিকে তারা পেট্রল পাম্প থেকে বাসায় চলে যান।