থাইল্যান্ডের সীমান্তবর্তী মিয়ানমারের শহর মায়াবতির নিয়ন্ত্রণ জান্তাবিরোধী সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর হাতে চলে যাওয়ার পর থেকে শহরটির বাসিন্দারা দলে দলে থাইল্যান্ডে পালানো শুরু করেছেন। খবর রয়টার্সের।
মিয়ানমারের দক্ষিণপশ্চিমাঞ্চলীয় প্রদেশ কারেন বা কায়িনের শহর মায়াবতি মিয়ানমার-থাইল্যান্ডের সীমান্তবর্তী শহর। সীমান্তের অপর পাশে থাইল্যান্ডের শহর মায়ে সোত। টানা কয়েক দিন সংঘাত চলার পর বুধবার শহরটির নিয়ন্ত্রণ নেয় জান্তাবিরোধী সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর জোটের যোদ্ধা বাহিনী। জোটের অন্যতম সদস্য ও কারেনভিত্তিক সশস্ত্র গোষ্ঠী কারেন ন্যাশনাল ইউনিটি (কেএনইউ) এই বাহিনীর নেতৃত্ব ছিল।
বুধবার মূলত মায়াবতি শহরের প্রধান সামরিক ঘাঁটিটির নিয়ন্ত্রণ নেয় বিদ্রোহীরা। সে সময় ঘাঁটিটিতে ২০০ জন সেনা অবশিষ্ট ছিলেন। তারা সবাই পিছু হটেছেন।
এদিকে, সংঘাত শুরুর পর থেকেই সীমান্ত পাড়ি দিয়ে থাইল্যান্ডের মায়ে সোত শহরে আশ্রয় নেওয়া শুরু করেছিলেন মায়াবতির লোকজন। বিদ্রোহী গোষ্ঠী ক্ষমতা নেওয়ার পর আশ্রয়প্রার্থীদের হার আরও বেড়েছে। থাইল্যান্ডের সরকারি তথ্য অনুযায়ী, প্রতিদিন মায়াবতি ও তার আশপাশের এলাকা থেকে গড়ে চার হাজার মানুষ মায়ে সোতে আশ্রয় নিতে আসছেন।
এই আশ্রয়প্রার্থীদের মধ্যে অন্যতম মোয়ে মোয়ে থেট সান। ৩৯ বছর বয়সী এই নারী নিজের সন্তানদের নিয়ে বাড়িঘর ছেড়ে মায়ে সোত শহরে এসে আশ্রয় নিয়েছেন।
রয়টার্সকে মোয়ে মোয়ে বলেন, ‘সেনাবাহিনী পরাজিত হয়েছে ঠিকই, কিন্তু তারা ফিরে আসবে এবং বিমান হামলা শুরু করবে। এর আগে অন্যান্য শহরে এমন ঘটেছে।’
‘এ কারণেই আমি এখানে পালিয়ে এসেছি। কারণ তারা থাইল্যান্ডে এসে বোমা বর্ষণ করতে পারবে না।’
থাইল্যান্ডের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইতোম্যেধ মায়ে সোত সফর করেছেন। সেই সঙ্গে মিয়ানমারে ক্ষমতাসীন জান্তাকে সহিংসতা বন্ধের আহ্বানও জানিয়েছেন।
জান্তা সরকারের অন্যতম মুখপাত্র জাও মিন তুন শুক্রবার মিয়ানমারের সংবাদমাধ্যমগুলোকে বলেছেন, মায়ে সোতে আশ্রয় নেওয়া নাগরিকদের ফিরিয়ে আনতে থাই সরকারের সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছে মিয়ানমারের সরকার।
এ ব্যাপারে আরও বিস্তারিত জানতে জাও মিন তুনের সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ করেছিল রয়টার্স, তবে তিনি ফোন ধরেননি।
২০২০ সালের নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ তুলে ২০২১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি অভ্যুত্থানের মাধ্যমে মিয়ানমারের গণতন্ত্রপন্থী নেত্রী অং সান সুচির নেতৃত্বাধীন এনএলডি সরকারকে হটিয়ে জাতীয় ক্ষমতা দখল করে দেশটির সামরিক বাহিনী। সেনাপ্রধান জেনারেল মিন অং হ্লেইং এই অভুত্থানে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, ক্ষমতা দখলের পর গঠিত সামরিক সরকারের প্রধানও হন তিনি।
অভ্যুত্থানের সময়েই বন্দি করা হয়েছিল অং সান সুচি, তার নেতৃত্বাধীন সরকারের মন্ত্রী-এমপি এবং তার রাজনৈতিক দল ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসি’র (এনএলডি) হাজার হাজার নেতা-কর্মীকে। সামরিক বাহিনী ক্ষমতা দখলের পর মিয়ানমারের গণতন্ত্রপন্থি জনগণ প্রথম দিকে ব্যাপক আকারে বিক্ষোভ-আন্দোলন শুরু করেছিলেন, কিন্তু প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করে সেসব বিক্ষোভ দমন করেছে সামরিক সরকার।
তবে তার পর থেকে গণতন্ত্রপন্থি জনগণের একটি অংশ যোগ দিতে শুরু করেন সামরিক বাহিনী বিরোধী বিভিন্ন সশস্ত্র রাজনৈতিক গোষ্ঠীতে। গত বছর অক্টোবর থেকে বেশ কয়েকটি সশস্ত্র গোষ্ঠী একযোগে হামলা শুরু করে সামরিক বাহিনীর ওপর। এখনও সেই সংঘাত চলছে এবং ইতোমধ্যে দেশটির প্রায় ১০ শতাংশ ভূখণ্ডের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো।
কৌশলগত কারণে বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলো সীমান্ত শহরগুলোকে গুরুত্ব দিচ্ছে। এর আগে বাংলাদেশ, চীন এবং ভারতের সীমান্তবর্তী শহরগুলোর দখল নিলেও এই প্রথম থাইল্যান্ডের সীমান্তবর্তী কোনো শহরের পূর্ণ দখল নিলো নাগ।
দেশটির রাজনীতি বিশ্লেষক থান সোয়ে নাইং বলেছেন, ‘বর্তমানে বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর লক্ষ্য সীমান্তবর্তী শহরগুলো দখল করে সীমান্ত বাণিজ্যের নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে নেওয়া। মায়াবতি দখলের মধ্যে দিয়ে সেই লক্ষ্য একপ্রকার পূরণ হয়েছে।’
‘আমার ধারণা, এখন তারা মিয়ানমারের বড় শহরগুলোর দখল নেওয়ার জন্য প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করবে।’
সূত্র : রয়টার্স